মাহে রমযান ও রোযার ফযীলতঃ
রোযা ফারসী শব্দ, আরবী সিয়াম বা সাওম। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের দৃষ্টিতে সিয়াম অর্থ সোবেহ সাদেক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্ভোগ ও শরীয়াত নির্ধারিত বিধি-নিষেধ হতে নিয়তসহ বিরত থাকাকে রোযা বলে।
শরীয়াতে ঈমান, সালাত ও যাকাতের পরেই রোযার স্থান। ইহা ইসলামের চতুর্থ রোকন। আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে ইহা একটি অপরিহার্য ইবাদত। বস্তুত রোযা মানুষকে কু-প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে, রাসূল (সা.) বলেন; রোযা ঢাল স্বরূপ।
রোযা কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যেই রাখা হয়। এ কারণে রোযাদারদেরকে আল্লাহ অত্যাধিক ভালবাসেন। হাদীসে কুদসীতে এসেছে আল্লাহ বলেন; রোযা একমাত্র আমারই জন্য আমি নিজেই এ পুরস্কার দেব। কুরআনে শুধু রোযা রাখার হুকুমই হয়নি, বরং রোযার নিয়ম পদ্ধতিও বলে দেয়া হয়েছে, রমযানের মহাত্ম ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
যে মাসের রোযা শরীয়ত ফরজ করেছে তার ফযীলত ও বরকত অনেক। এ কারণেই রাসূলে কারীম (সাঃ) এ মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্টতম বলেছেন।
আমরা জানি পৃথিবীর সব দেশের মানুষই বার মাসে বছর হিসাব করে, কিন্তু এই বার মাসের মধ্যে একটি মাসের গুরুত্ব এতো বেশি কেন? কোন কারণে এই মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়। মূলত এই মাসের সম্মান মর্যাদা গুরুত্ব ফযীলত বরকত নাজাত মাগফিরাত একমাত্র কুরআন এর সম্মানের কারণে হয়েছে।
কুরআন যদি এই মাসে নাযিল না হতো তাহলে এই রমযান মাসের এত ফযীলত হতো না। যার কারণে প্রত্যেক এবাদতের গুণ এত বৃদ্ধি পেল, তাকে আজ আমরা বুঝার চেষ্টা করি না। তার সাথে আমরা ভাল ব্যবহার করি না । তাকে দিয়ে নিজ , পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এক কথায় কিছুই পরিচালনা করি না। অথচ আমরা রমযান মাসের প্রতিটি দিনই রোযা রাখি।
আসলে কুরআনকে সঠিক নিয়মে বুঝার জন্যই এ মাসকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন; রমযান মাস যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও প্রভেদকারী কুরআন অবর্তীণ হয়েছে। (সূরা বাকারা ১৮৫)
রমযানের রোযা পালন ফরজ, মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, ফলে আশা করা যায় যে তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে।” অর্থাৎ তোমরা মুত্তাকী হতে পারবে। (সূরা বাকারা : ১৮৩)
উপর্যুক্ত আয়াত শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয় বরং এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে, মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোযার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার একটি স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। রোযার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওযর বা রোগ ছাড়া রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দিবে সে যদি সারা জীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরণ হবে না”।
প্রকৃত পক্ষে রমযান এসেছে বান্দাকে তাকওয়া শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সারা বছর মানুষ শয়তানের কুআচরনের কারণে কিছু না কিছু গুনাহ করে থাকে। রোযার এক মাসে সাধনা করলে ঐ সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এই তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয় । আল্লাহ উপর ঈমান, তার গুণাবলীর দয়া অনুগ্রহের গভীরে অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তার অন্যগুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়।
প্রকৃত রোযাঃ- রোযার এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসিল করা যেতে পারে যখন রোযা পূর্ণ অনুভূতির সাথে রাখা হবে এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে রোযাকে রক্ষা করা হবে। যার প্রভাবে রোযা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত রোযা হলো যার সাহায্যে মানুষ তার মন মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করে।
* রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
*এমন বহু রোযাদার আছে যে, রোযাদার ক্ষুধা তৃষ্ণার্ত ভোগ করা ছাড়া তাদের নেকীর পাল্লায় আর কিছু পড়ে না। (মিশকাত)
এবার আসুন রোযাপালনকারীর জন্য কি সু-সংবাদ রাসূলে কারীম (সাঃ) দিয়েছেন এবং তাদের মর্যাদা কত উর্ধ্বে জেনে নেই ;
১. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি জিনিস দান করবে তাকে জান্নাতের দরজা থেকে এই বলে ডাকা হবেঃ হে আল্লাহর বান্দা! এই যে এই দরজাটি তোমার জন্য ভালো। কাজেই নামাযীদেরকে নামাযের দরজা হতে ডাকা হবে। মুজাহিদদেরকে ডাকা হবে জিহাদের দরজা হতে। রোযাদাদেরকে ডাকা হবে “রাইয়্যান” দরজা হতে । দাতাদেরকে ডাকা হবে সদাকার দরজা হতে । আবু বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার বাপ মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, কোন ব্যক্তিকে কি এ সবগুলি দরজা থেকে ডাকা হবে ..? যদিও এর কোন প্রযোজন নেই। জবাব দিলেন হ্যাঁ । আর আমি আশা করি তুমি সবগুলোতে অর্ন্তভূক্ত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
২. সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (সাঃ) বলেনঃ- জান্নাতের একটি দরজা আছে । তাকে বলা হয় রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে কেবল মাত্র রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে রোযাদারগণ কোথায় ? তখন রোযাদারগণ দাড়িয়ে যাবে, তাদেরকে প্রবেশের আদেশ দেওয়া হবে। রোযাদারগণ প্রবেশ করার পর দরজা টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এবং তারপর এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
৩. আবু হুরায়রা (রাঃ থেকে বর্নিত। নবী করীম (সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান সহকারে ও সাওয়াব লাভের প্রত্যাশায় রমযানের রোযা রাখে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মা’ফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
৪.আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, যখন রমযান মাস আসে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয় । আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং শয়তানকে শৃংখলিত করে রাখা হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
শেষ কথা:- সত্যিকার মুমিন বান্দা সর্বদাই আল্লাহর এবাদত করবে। কোন নির্দিষ্ট মাস, জায়গা অথবা জাতির সাথে মিলে আমল করবে না, বরং সর্বদা সে এবাদত করবে। মুমিন বান্দা মনে করবে যিনি রমযানের প্রভূ তিনি অন্যান্য সকল মাসেরও প্রভূ । তিনি সকল কাল ও স্থানের প্রভূ । রমযান শেষ হয়ে গেলেও শাওয়ালের ছয় রোযা, আশুরা, আরাফা, সোমবার, বৃহস্পতিবার ইত্যাদি নফল রোযা রয়েছে। তারাবীহের নামায শেষ হয়ে গেলেও তাহাজ্জুদ নামায বাকি আছে সারা বছর। অতএব নেক আমল সব সময় করা যায়। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন
0 Comments